বিশেষ প্রতিনিধি:
বরগুনার বহুল আলোচিত প্রতারক মোশাররফ হোসেন হারুন অবশেষে নিজেই নিজের ফাঁদে আটকা পড়েছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) স্বাক্ষর জাল করে অন্যকে ফাঁসাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন তিনি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, স্বাক্ষর জালিয়াতি, ঘুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে একটি হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
গ্রেফতার
রবিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় এলাকাবাসী প্রতারক হারুনকে আটক করে বরগুনা সদর থানায় খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে। পরে বিকেল ৩টার দিকে তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়।
প্রতারণার কৌশল
পেশায় আয়লা কলেজের গ্রন্থাগারিক হারুন নিজ বাড়িতে ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া প্রতিবন্ধী (অটিজম) বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের নামে তিনি গরিব শিক্ষকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। শেখ হাসিনার স্বামীর নামে বিদ্যালয় হওয়ায় বিগত সরকারের সময়ে তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে সাহস পাননি। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা টাকা চাইতে শুরু করলে হারুন উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
ঘুষ ফেরত চাইলে পাল্টা মামলা
বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য শাহ আলম হাওলাদার ভুক্তভোগী শিক্ষকদের পক্ষ নিয়ে হারুনকে ঘুষের টাকা ফেরত দিতে বলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হারুন তার বিরুদ্ধেই আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
কিন্তু ইউএনও বদলি হলে সুযোগ নিয়ে হারুন ভুয়া তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে ইউএনও’র স্বাক্ষর জাল করে আদালতে জমা দেন তিনি।
জালিয়াতির প্রমাণ আদালতে
মামলার আসামি শাহ আলম হাওলাদার তদন্ত প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাইয়ের আবেদন করলে আদালত তা সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে পাঠান। বর্তমান ইউএনও মোঃ শামীম মিয়া লিখিতভাবে জানান, প্রতিবেদনে তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। আদালত এই ঘটনাকে গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন এবং বেঞ্চ সহকারীকে নতুন মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন।
১০ সেপ্টেম্বর সরকারি নাদিরা বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন। এতে হারুনকে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০ ও ৪৭১ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রতারণামূলকভাবে ও অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে হারুন ইউএনও’র স্বাক্ষর জাল করে আদালতে ভুয়া তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। যা স্পষ্টতই জালিয়াতি ও দণ্ডনীয় অপরাধ। আদালত এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন।
পুরনো অভিযোগ
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হারুনের বিরুদ্ধে শুধু প্রতারণাই নয়, অতীতে একটি হত্যা মামলা সহ একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা কৌশলে প্রভাব খাটিয়ে প্রতারণা, ঘুষ, জালিয়াতি ও সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে আসছিলেন। সরকারি দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়ে তিনি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন।
এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া
গ্রেফতারের পর এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তারা জানান, হারুনের ভয়ে এতদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। একজন শিক্ষক বলেন, “আমরা অনেকেই জীবনের সঞ্চয় দিয়ে চাকরির জন্য টাকা দিয়েছি, কিন্তু শেষমেষ প্রতারণার শিকার হয়েছি। আজ তাকে গ্রেফতার করায় আমরা স্বস্তি পেয়েছি।”
অন্য এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “অপরের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয় এই প্রবাদটাই আজ হারুনের ক্ষেত্রে সত্য হয়েছে।”
বরগুনায় আলোচিত এই প্রতারকের গ্রেফতারে জনমনে স্বস্তি ফিরলেও ভুক্তভোগীরা তাদের টাকা ফেরত ও বিচার পাওয়ার দাবি তুলেছেন। আদালত বিষয়টি তদন্তাধীন রেখেছে এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে হারুনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।